বেঁচে থাকলে আজ এই সকল শহিদরাও এইচএসসি পরীক্ষায় বসত - protidinislam.com | protidinislam.com |
জাতীয়

বেঁচে থাকলে আজ এই সকল শহিদরাও এইচএসসি পরীক্ষায় বসত

  প্রতিনিধি ২৬ জুন ২০২৫ , ২:৩৯:৩১ প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলাম ডেস্ক: আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা। রাজধানীসহ সারাদেশের কলেজগুলোতে পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতি আর অপেক্ষার অবসান হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখতে প্রবেশ করবে পরীক্ষাকেন্দ্রে। কিন্তু এই পরীক্ষার দিনেই কিছু চেয়ার অদৃশ্য এক শূন্যতায় ভরে আছে।

সেসব চেয়ারে বসার কথা ছিল ছয় তরুণের—আবদুল্লাহ বিন জাহিদ, মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া (ফারহান ফাইয়াজ), শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ, আফিকুল ইসলাম সাদ, মারুফ হোসেন এবং মো. আব্দুল আহাদ সৈকত। আজকের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল তাদেরও। কিন্তু তারা কেউ নেই।

গত বছরের জুলাইয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে অভ্যুত্থান চলাকালে আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন এ ছয় শিক্ষার্থী। কেউ শহীদ হয়েছেন জুলাইয়ের মাঝামাঝি, কেউ আগস্টের শুরুতে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুর কিছুদিন আগে ফেসবুকে লিখে গিয়েছেন বর্ণময় বিদায়বার্তা। আর আজ, তাদের সহপাঠীরা পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে চোখের পানি মুছেছে। কারণ বন্ধুরা নেই। আছে কেবল তাদের গল্প, কিছু স্মৃতি, কিছু না-পাওয়া।

ছয় বন্ধু ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। একই পাড়ায় থাকায় বন্ধুত্বের বন্ধন ছিল অটুট। পড়েছে আলাদা কলেজে, তবে প্রতিদিন দেখা হতো। পরীক্ষা সামনে আসায় প্রস্তুতি নিচ্ছিল একসঙ্গেই। কিন্তু আজ, তাদের একজন, আবদুল্লাহ বিন জাহিদ নেই। তার মা ফাতেমা তুজ জোহরার চোখে এখনও জলের ধারা। বললেন, ‘ওর কলেজ থেকে পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে আমাকে ডেকেছিল। আমি যাইনি।

মনে হচ্ছিল, সহ্য করতে পারব না।’ আবদুল্লাহ শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট রাতে উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি। মৃত্যুর তিন মাস পর ছিল তার ১৭তম জন্মদিন। বড় ছেলের মৃত্যুর ১৪ দিনের মাথায় ছোট ছেলে মাহমুদুল্লাহ বিন জিসানের কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে। চলতি বছরের ১৮ মার্চ হৃদ্‌রোগে মারা যান ফাতেমার স্বামীও।

এখন তিনি থাকেন উত্তরা আব্দুল্লাহপুরে। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘ওর পাঁচ বন্ধু লামিম, হাসান, সালেহীন, রাকিব ও মেহেদি ফোন করে অনেক কেঁদেছে। বলেছে, খালাম্মা দোয়া করবেন। ওদের মুখেই যেন আমার ছেলেকে খুঁজে পাই।’

ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া, ডাকনাম ফাইয়াজ। ফেসবুকে তার নাম ছিল ‘ফারহান ফাইয়াজ’। সেই নাম এখন হয়ে উঠেছে জুলাই অভ্যুত্থানের এক প্রতীক। ১৮ জুলাই আন্দোলনের সময় তার বুকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মারা যান ঘটনাস্থলেই। বাবা শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া জানালেন, ‘ছেলেটা গবেষক হতে চেয়েছিল।

বিদেশে পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরে গবেষণা করতে চেয়েছিল।’ মঙ্গলবার তিনি কলেজে গিয়ে ছেলের রেজিস্ট্রেশন কার্ড আনতে গিয়েছিলেন। মন ভার হয়ে আসে তার। বলেন, ‘রাতে ওর বন্ধুরা ফোন করে বলে—আঙ্কেল, ফারহান থাকলে আজ পা ছুঁয়ে সালাম করত, দোয়া চাইত। আমরাও আপনার সন্তান। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে ৪ আগস্ট শহীদ হন শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ। ছিলেন বিএএফ শাহীন কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী। গানপ্রিয় ও স্কাউট সদস্য আহনাফকে মঙ্গলবার বাংলাদেশ স্কাউটস ‘গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। প্রধান উপদেষ্টা নিজ কার্যালয়ে আহনাফের মায়ের হাতে পুরস্কারটি তুলে দেন। পুরস্কার হাতে নিয়েই স্মৃতিফলকে গিয়ে ছেলের সোনালি প্রতিকৃতি ছুঁয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন—আজ ও বেঁচে থাকলে পরীক্ষার হলে যেত। আহনাফের বাবা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘পরীক্ষার সময় এসেছে, বুকটা আরও বেশি খালি লাগছে। ছেলের রেজিস্ট্রেশন কার্ডটা এখন শুধু যন্ত্রণার স্মৃতি।’

মারুফ হোসেন—যার বয়স ছিল ১৯ বছর। ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করেছিল ডিবি। সেই থেকেই তাকে নিয়ে পরিবার ছিল শঙ্কিত। এরপর বরিশালে নানা বাড়িতে রাখা হয়। কাজীরহাট একতা ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এবার তার এইচএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। কিন্তু গত ১৯ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি।

তার মরদেহ পাওয়া যায় তিন দিন পর, অর্ধগলিত অবস্থায়। বাবা মো. ইদ্রিস বলেন, ‘ও ছিল আমার বন্ধু। কবরস্থান থেকে বলা হয়েছে ১০ লাখ টাকা না দিলে কবরটা রাখবে না। আর ওর মা ছেলের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’

মো. আব্দুল আহাদ সৈকত (১৭) ছিলেন ঢাকা কমার্স কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সৈকত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে অংশ নেন বাবার সঙ্গে। বিকেল সাতটার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজের সামনে মাথায় গুলি লেগে শহীদ হন তিনি। তার বাবা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এক ঘণ্টা বেঁচেছিল। আমি ছিলাম পাশে। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। আমার ছেলে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, আজ তাকে কেবল কবরে দেখতে পারি।’

আফিকুল ইসলাম সাদ (১৮) ছিলেন সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। ৫ আগস্ট ধামরাইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ৮ আগস্ট মৃত্যু হয় তার। ফ্রিল্যান্সিং করে পরিবারের জন্য কিছু করতে চাওয়া সাদ ছিল গ্রাফিক ডিজাইনে পারদর্শী। মৃত্যুর আগের দিন, ৪ আগস্ট তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘যে দেশের ইতিহাস রক্ত দিয়ে শুরু হয়েছে, ওই ইতিহাস আবার লিখতে রক্তই লাগবে।’ সাদকেও আহনাফের মতো মঙ্গলবার ‘গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়েছে। তার বাবা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলেটা এখনো চোখের সামনে ভাসে। নিজের ডিজাইনে আন্দোলনের পোস্ট বানিয়ে ফেসবুকে দিত। পরিবারকে সাহায্য করতে চাইত।’

আজকের এই দিনটি কারও কাছে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরুর, কারও কাছে শোকের বার্তা। কেউ পরীক্ষার হলে প্রবেশ করেছে কলম হাতে, কেউ দাঁড়িয়ে থেকেছে সন্তানের কবরের পাশে।

কেউ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে, আর কেউ শুধুই তাকিয়ে থেকেছে ছেলের ছবির দিকে। আজকের এইচএসসি পরীক্ষায় তারা নেই, কিন্তু তাদের জায়গাটা শূন্য নয়—ভরা আছে হাজারো অশ্রু, অটুট বিশ্বাস আর রক্তের ইতিহাসে।

আরও খবর

Sponsered content