প্রতিনিধি ১ জুলাই ২০২৫ , ৩:১৪:০০ প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলাম ডেস্ক: বুকের পাঁজরে গুলি লেগে ঢাকার রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিলেন সৈকত চন্দ্র দে সুমন (৪৩)। সেদিন ২০ জুলাই, শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। শনির আখড়া বাজারের গলিতে ছিলেন তিনি—এক হাতে মায়ের প্রেসক্রিপশন, অন্য হাতে ওষুধের প্যাকেট। গুলিবিদ্ধ হওয়ার মুহূর্তে ফোনে কথা বলছিলেন স্ত্রী স্বপ্না রানীর সঙ্গে। স্ত্রীর ভাষায়, ‘হঠাৎ ফোনটা কেটে গেল। একটু পর বান্ধবীর ফোনে শুনি, আমার সুমন আর বেঁচে নেই।’
আরো পড়ুন:
ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ঘটাইয়া বাড়িত আইয়াম— আইল ঠিকই, কিন্তু লাশ হইয়া’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল ঢাকায় পুলিশের গুলিতে একের পর এক প্রাণ ঝরছিল। রাজপথে উত্তাল জনগণের মাঝে ছিলেন না শহীদ সুমন। তিনি ছিলেন ঘরে ফেরার তাড়নায়, মায়ের জন্য দুশ্চিন্তায়। কিন্তু সেই পথেই কেড়ে নেওয়া হলো এক পরিবারে একমাত্র ভরসা, এক সন্তানের বাবাকে। নিহত হওয়ার পরে তার মরদেহ স্থানীয়রা পাশের গলিতে এনে রাখে।
শনির আখড়ার রুপসী গার্মেন্টস গলির ভাড়া বাসায় থাকতেন শহীদ সুমন। তার স্ত্রী স্বপ্না রানী বলেন, ‘শাশুড়ি ছিলেন অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এনেছিলাম। কয়েকটা হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা করাচ্ছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় ওষুধ কিনে বাসায় ফিরছিল সুমন। কিন্তু গুলিতে ও পড়ে যায় রাস্তায়। আমি ছুটে যাই—তখন দেখি ওর নিথর দেহ পড়ে আছে।’
শহীদ সুমনের ছোট ভাই চন্দন বলেন, ‘পরদিন ভোরে মরদেহ যাত্রাবাড়ী থানায় নেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ ময়নাতদন্তও করল না, জিডিও নেয়নি। উপায় না দেখে পরামর্শে মরদেহ বাড়িতে এনে ধর্মীয় রীতিতে শ্রাদ্ধ করে দাফন করি।’’
চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদি গ্রামে ১৯৮১ সালের ১ মে জন্ম সুমনের। বাবা ছিলেন প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষক, মা গৃহিণী। বড় সন্তান হিসেবে পরিবারে দায়িত্ব নিয়েছিলেন তরুণ বয়সেই। ১৯৯৭ সালে বোয়ালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯৯ সালে মতলব ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০০২ সালে একই কলেজ থেকে বি.কম পাশ করেন তিনি।
২০০৩ সাল থেকে আকিজ গ্রুপ, গ্রামীণ ব্যাংক, স্কয়ার টেক্সটাইল, ব্র্যাক, স্কুলে শিক্ষকতা—বিভিন্ন কর্মস্থলে কাজের পর ২০১৬ সালে মতিঝিল আনন্দ হাউজিংয়ে হিসাবরক্ষক পদে চাকরি নেন। ভাই চন্দনের সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। সন্ধ্যায় তিনটি টিউশন করিয়ে চলত সংসার। দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, মায়ের চিকিৎসা—সবই চালাতেন তিনি।
চন্দন বলেন, ‘আমার বড় ভাই ছাত্রজীবনে টিউশন করে আমাদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। আমাদের বাবার সামান্য আয়ে চলত না। তিনিই আমাদের বাবার জায়গায় দাঁড়িয়েছিলেন। ভাই ছিলেন বন্ধু, অভিভাবক, ভরসা। মা ঢাকায় এলে ভাইয়ের বাসায়ই থাকতেন। সেদিন মায়ের ওষুধ আনতে গিয়ে শহীদ হন তিনি। ভাইয়ের মৃত্যুর শোকেই সাত মাস পর মাও মারা যান।’
স্বপ্না রানী দে, স্ত্রী। প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন ২০১২ সালে। সুমনের মৃত্যুতে সব কিছুই বদলে গেছে। তিনি বলেন, ‘সেদিন আমাদের ঘরে ছিল মাত্র ২৫০ টাকা। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সাহায্যে দাফন শেষ করি। পরে রংপুরে বাবার বাড়িতে চলে আসি। সন্তানেরা এখন এখানেই পড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে ধ্রুবকে ক্রিকেটার আর মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন। বিকেএসপিতে ভর্তি করানোর কথাও বলতেন। কিন্তু আজ আমরা সম্পূর্ণ নিঃস্ব। আমার পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, চাকরি নাই, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
সরকারি সহায়তা সম্পর্কে তিনি জানান, ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২ লাখ, জামায়াত থেকে ২ লাখ এবং বিএনপি থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। এখন ওই টাকা থেকেই সন্তানদের খরচ চলে। কিন্তু এটা তো বেশি দিন চলবে না।’
১২ বছরের ছেলে ধ্রুব বাবার স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ‘আমার বাবা বলত, আমি বিকেএসপিতে যাব। এখন সব শেষ। আমি বিচার চাই। কে মেরেছে, কেন মেরেছে—তা জানতে চাই।’
স্বপ্না রানীর একটাই দাবি, ‘আমার স্বামী কোনো রাজনীতিতে ছিল না। সে ছিল শুধু একজন দায়িত্বশীল ছেলে, স্বামী, পিতা। তার মৃত্যুর বিচার চাই। রাষ্ট্র যদি ন্যায্য বিচার দিতে না পারে, তাহলে আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার।
মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন
আগ্রহী পুরুষ/ মহিলা যোগাযোগ করতে পারেন।
📞 মোবাইল: 01717289550 (WhatsApp)
📧 ইমেইল:
masayeedtonmoy@gmail.com