প্রতিনিধি ৩ জুলাই ২০২৫ , ৬:০৭:২৬ প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলাম ডেস্কঃ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার জুলাই–আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে নিহত অনেকেই এখনও অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে সমাহিত। রাজধানীর বিভিন্ন কবরস্থানে অন্তত ১২০ জন শহীদকে দাফন করা হয়েছে ‘বেওয়ারিশ’ মরদেহ হিসেবে — কেউ তাদের ঠিকানা, নাম বা পরিবারের সন্ধান পায়নি।
গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিফলক নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন, তবে বেওয়ারিশ কবরস্থ শহীদদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
যদিও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া শহীদের লাশ শনাক্তে সরকার একটি কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে। শিগগিরই কমিটি বেওয়ারিশ লাশ শনাক্তের কার্যক্রম শুরু করবে।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জুলাই গণঅভ্যুত্থান শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (যুগ্মসচিব) মোহাম্মদ ফারুক হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া শহীদদের লাশ শনাক্তে একটি কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি বিষয়গুলো তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন জমা দেবে। প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে।’
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, সেচ্ছাসেবকলীগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে বহু আন্দোলনকারী প্রাণ হারান।
আন্দোলনকারীদের দাবি, সেসব শহীদের অধিকাংশই ছিলেন নিরস্ত্র, যারা গণতন্ত্র, ন্যায্যতা ও নিজের অধিকার রক্ষায় রাস্তায় নেমেছিলেন। আন্দোলনে প্রায় হাজার খানেক ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮৩৪ জনের নাম গেজেটভুক্ত করা হলেও এখনো ১২০ জন বেওয়ারিশ হিসেবে রয়েছেন।
রায়েরবাজারে শহীদদের কবর জিয়ারত করছেন নাহিদ ইসলাম
গণঅভ্যুত্থানে বিভিন্ন সময় নিহত লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্র ও মর্গ থেকে গুম করার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে অনেকগুলো লাশ তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়েছিল। এ ছাড়া আগুনে পুড়ে যাওয়া অনেকের লাশও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এমন অন্তত ১২০ জন শহীদের মরদেহ পরিচয় না থাকায় ‘‘বেওয়ারিশ’’ হিসেবে দাফন করা হয়। নিহতদের পরিবারের কেউ কেউ তখন নিখোঁজ আত্মীয়কে খুঁজে না পেয়ে কবরস্থানের আশপাশে ছবি হাতে ছুটে বেড়িয়েছিলেন, কিন্তু অধিকাংশ মরদেহেরই কোনো আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শনাক্ত হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সংস্থার উদ্যোগে ১১৪টি মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এই লাশগুলো রায়েরবাজারে দাফন করা হয়েছে। প্রতিটি কবরের পাশে বাঁশের টুকরো আছে, কিন্তু কোনো স্বীকৃত নামফলক নেই। গত বছরের নভেম্বর–ডিসেম্বরের সময়ে সরকার ‘গণ–অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেল’ গঠন করলেও এখনো এদের চূড়ান্ত শনাক্ত তালিকা প্রকাশ হয়নি।
রায়েরবাজার কবরস্থানে কর্মরত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এ পর্যন্ত ১১৪টি মরদেহ এখানে দাফন হয়েছে। বেশিরভাগই রাতের আঁধারে আনা হয়। আত্মীয়স্বজন কেউ থাকেন না।”
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ ছাত্র-জনতা বুক পেতে দিয়েছিল বলেই আজ আমরা কথা বলছি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এখনও তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। অন্তত তাদের নামটুকু ইতিহাসে থাকা উচিত। তাদের দাবি, ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করে পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে শহীদ পরিবারগুলোর অন্তত কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সে পথে হাঁটেনি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, আন্দোলন বা সংঘর্ষে নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই ঘটনায় দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনো তদন্ত প্রতিবেদন, মৃতের তালিকা বা ডিএনএ ডাটাবেস প্রকাশ না হওয়া গভীর অবহেলার প্রমাণ। তারা দ্রুত ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদদের সম্মান জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
১২০ জন অজ্ঞাতপরিচয় শহীদ এখনও চিহ্নিত না হওয়ার ফলে তাদের পরিবারের যথাযথ মুল্যায়ন, মর্যাদা ও মূল দাবি বিলম্বিত হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন কবরস্থানে বাঁশ হাতে পরিচয় তুলে দেওয়ার চেয়ে এখন সময় এসেছে দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ডিএনএ শনাক্তকরণ, নামফলকে স্থাপন, এবং রাষ্ট্রীয় পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার।