অপরাধ

হায়রে হায়!আড়াই বছরের প্রকল্প ১০ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি, ব্যয় বেড়েছে ১৬শ কোটি

  প্রতিনিধি ১৭ জুলাই ২০২৫ , ৫:৩২:৫১                        

ইসলাম ডেস্ক: মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে ২০১৪ সালে দেশের ১০০ উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হয়। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের আড়াই বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

আরো পড়ুন:

ভাতার চেয়ে বড় ছিল জাতীয় মর্যাদা — শিক্ষক সমাজ কি তা ভুলে যাচ্ছে?”

কিন্তু এক দশকের বেশি অতিবাহিত হলেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। ছয় দফা সময় বাড়ানোর পরও অগ্রগতি মাত্র ৭০ শতাংশ। নির্ধারিত মেয়াদের চেয়ে এক দশকের বেশি সময়েও প্রকল্প শেষ না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য তো পূরণ হয়নি; বরং বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণে খরচ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

শিক্ষার খবর সহ সকল প্রকার খবর সবার আগে জানতে
আমাদের পেইজে ফলো দিয়ে সাথেই থাকুন সারাক্ষণ

বারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কারণে অনুমোদনের চেয়ে প্রায় ১ হাজার ৬০১ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। এখন নতুন করে আরও ১৮ মাস সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

২০১৪ সালের শুরুতে অনুমোদিত প্রকল্পটির প্রাথমিক বরাদ্দ ছিল ৯২৪ কোটি ৩ লাখ টাকা। কিন্তু সময় বাড়ার পাশাপাশি কয়েক ধাপে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ (টিএমইডি) প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও ১৮ মাস সময় চেয়ে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) পাঠিয়েছে।

টিএসসি প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল দেশের বড় জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি করা। প্রথম ধাপে ১০০টি উপজেলায় টিএসসি স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যা থেকে প্রতি বছর ১ লাখ ৮ হাজার কারিগরি শিক্ষার্থীর স্নাতক হয়ে বের হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। শুরু হওয়ার এক যুগ পরও প্রকল্পের ৩০ শতাংশ কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। আরডিপিপিতে বলা হয়েছে, ১০০টির মধ্যে ৭২টি টিএসসি নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং এর মধ্যে ৬৬টি প্রতিষ্ঠান শর্তসাপেক্ষে হস্তান্তরও করা হয়েছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি স্থাপন, সাব-স্টেশন চালু এবং শিক্ষাক্রম চালুর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখনো শেষ হয়নি।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম ধাপে দুই বছর এবং ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রকল্প সংশোধন করা হয়।

সংশোধিত মেয়াদেও কাজ শেষ না হওয়ায় আরও ৫৪ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। তাতেও কাজ শেষ করতে না পারায় আরও তিন বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। দুই ধাপে পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ শেষ করতে পারেনি কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।

পরে প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয়। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে নতুন করে আরও ১৮৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং তিন বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।

কিন্তু সেই মেয়াদেও প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় পঞ্চম ধাপে আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পাঁচ ধাপে প্রায় ১১ বছর এবং ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা বাড়িয়েও কাজ শেষ না হওয়ায় তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে।

তৃতীয় সংশোধনীতে নতুন করে আরও ৫ কোটি টাকা এবং দেড় বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে আড়াই বছরের প্রকল্প ঠেকছে সাড়ে ১৩ বছরে। আর বারবার মেয়াদ বাড়ানোর ফলে ৯২৪ কোটি ৩ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ৫২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকায়।

অর্থাৎ বারবার সংশোধন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণে ১০০ টিএসসি নির্মাণ প্রকল্প শেষ করতে অতিরিক্ত ১১ বছর এবং ১ হাজার ৬০১ কোটি টাকা বেশি খরচ হচ্ছে।

সংশোধনের কারণ হিসেবে আরডিপিপি বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে নির্মাণসামগ্রীর দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। ফলে অনেক টিএসসির নির্মাণ ব্যয় বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া সাব-স্টেশন স্থাপন, যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় বিলম্ব প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে অপ্রত্যাশিত বিলম্বের কারণে খরচ বেড়েছে এবং নতুন সময়সীমা ও বাজেট অনুযায়ী ডিপিপি সংশোধনের প্রয়োজন। এ অবস্থায়, চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ৮০টি টিএসসির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলেও প্রকল্পের অবশিষ্ট ২০টি টিএসসির নির্মাণকাজ শেষ করে, শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, সরবরাহসহ অন্যান্য সব অঙ্গের কাজ শেষ করতে আরও ১ বছর ৬ মাস প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধিসহ প্রকল্পটি সংশোধন করা প্রয়োজন। অতিরিক্ত দেড় বছরের জন্য প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এজন্য ব্যয় বাড়ানোর দরকার।

ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রমের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ায় প্রকল্প সমাপ্তির জন্য কমপক্ষে দেড় বছর মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে। টিএসসির জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি আরডিপিপিতে প্রশাসনিক ব্যয় ও ওভারহেড খরচের হিসাবও পরিবর্তন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নতুন অর্থনৈতিক কোড যুক্ত হওয়ায় এসব ব্যয়ের আইটেম হালনাগাদ করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ (এলএফএস) উদ্ধৃত করে প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তুলনামূলকভাবে বেশি আয় করেন, যা প্রকল্পটির সম্ভাব্য ইতিবাচক প্রভাব তুলে ধরে; কিন্তু বাস্তবে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি।

শিক্ষা ও শ্রমবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি দ্রুত যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও জনবল নিয়োগ সম্পন্ন না হয়, তাহলে অবকাঠামো নির্মাণ করেও প্রকল্পের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না। প্রকল্পটি যে উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল—যেমন, দারিদ্র্য হ্রাস, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং স্থানীয় ও বৈদেশিক শ্রমবাজারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি—সেটার বাস্তবায়ন এখনো দুরূহ।

কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ নতুন করে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠালেও সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এত সময় ও অর্থ ব্যয়ের পরও প্রকল্পটি কি আদৌ কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারবে?

পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ভালো হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, কার্যকর সমন্বয়ের অভাব এবং ঠিকাদারদের জবাবদিহিতার ঘাটতি প্রকল্পটিকে পিছিয়ে দিয়েছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন অস্বাভাবিক ধীরগতির কারণ জানতে প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল কাসেম মোহাম্মদ জাহাংগীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। প্রকল্প পরিচালকের ব্যবহৃত নম্বরে গত দুদিন ধরে বারবার ফোন দিলেও তার সাড়া মেলেনি। এ কারণে তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

বিষয়টি অবহিত করে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন আল রশীদ কালবেলাকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন ধীরগতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন একটা নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্প শেষ করতে পারলে প্রকল্পের এত বেশি টাকা খরচ হতো না।

বারবার মেয়াদ বাড়ানোর কারণে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে, এটাকে অপচয় বললেও ভুল হবে, এটা চরম অপচয়। শুরু থেকে এই প্রকল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।খবর কালবেলা

Google News

প্রতিদিন ইসলাম অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে
Google News ক্লিক করুন।

আরও খবর

Sponsered content