জাতীয়

পাবনায় ক্রমাগত লোকসানে বিলীন হচ্ছে তাঁত

  প্রতিনিধি ২৭ জুলাই ২০২৫ , ৫:৩১:৩৬                        

: তাঁতে কাপড় বুনছেন এক নারী শ্রমিক
* বেড়েছে কাঁচামালের দাম, কমেছে তাঁতে বোনা কাপড়ের চাহিদা
* কমেছে কাপড়ের দাম
* ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের হিসাব না মেলায় পেশা বদলেছেন তাঁত মালিকরা
* ব্যাংক লোনেও জটিলতা ও সুদ বৃদ্ধি

পাবনার তাঁতের লুঙ্গির সুনাম বহু যুগের। সোনালি অধ্যায় ছিল ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড়েরও। তবে এসব সুনাম ও ঐতিহ্য এখন শুধুই বইয়ের পাতায় স্থান পেতে চলেছে। নেই তাঁত বা তাঁতিদের রঙিন সুতোয় বোনা সেই সোনালি গল্প। রং, সুতা ও কাঁচামালের দরবৃদ্ধি এবং এর বিপরীতে তাঁতে বোনা কাপড়ের চাহিদা কমায় নিঃস্ব হয়েছেন তাঁতি বা কারখানা মালিকরা।

গত এক দশকেরও কম সময়ে জেলায় বিলীন হয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ তাঁত। পেশা বদলেছে হাজারো মানুষ।

সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের কুড়িপাড়া এলাকা। উপজেলার প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ তাঁত ছিল এখানে। দুই বছর আগেও এ এলাকায় তাঁতের সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের মতো। এসব তাঁতের ওপর নির্ভরশীল ছিল প্রায় ২০ হাজার পরিবার। তবে এখন সেদিন নেই। ব্যাপক লোকসানে দু’বছরে তাঁত কমেছে দেড় হাজার। পেশা হারিয়ে বিপাকে ৬ হাজার পরিবার।

পাবনায় ক্রমাগত লোকসানে বিলীন হচ্ছে তাঁত

কুড়িপাড়া বাজার এলাকার শামীম হোসেন এখন পেশায় তাঁত শ্রমিক। অথচ ৫ বছর আগেও ১০টি তাঁতের মালিক ছিলেন তিনি। দারুণ রোজগারে পরিবার নিয়ে সুখের দিন ছিল তার। এখন তিনি শুধুই শ্রমিক।

তিনি জানান, একদিকে সুতা ও রংসহ কাপড় তৈরির খরচ বৃদ্ধি, অন্যদিকে বাজারে কাপড়ের চাহিদা কম। এতে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের হিসাবের গরমিলে ২০ লাখ টাকা দেনা হয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন তিনি। পরে দেনা মেটাতে বাধ্য হয়ে সব তাঁত বিক্রি করে ৫০০ টাকা হাজিরায় কাজ করে জীবিকা চালান।

শিক্ষার খবর সহ সকল প্রকার খবর সবার আগে জানতে
আমাদের পেইজে ফলো দিয়ে সাথেই থাকুন সারাক্ষণ

একইরকম অসহায়ত্বের গল্প শোনালেন ওই এলাকার আসাদুজ্জামানের স্ত্রী সুবর্ণা পারভীন আকিবা। তিনি জানান, প্রায় অর্ধশত বছরের পুরোনো তাঁত ব্যবসা তার শ্বশুরকুলের পূর্বপুরুষদের। সবশেষ স্বামী আসাদুজ্জামান হাল ধরেছিলেন ব্যবসার। বড় কারখানায় ৫০টি তাঁতে ২০০ শ্রমিক কাজ করতেন। এলাকায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীবনযাপন ছিল তাদের। তবে লোকসানে ২ কোটি টাকার ঋণের বোঝা সইতে না পেরে তাঁত বিক্রি করে ব্যাংকলোন পরিশোধ করেন। এখন কোনোমতে জীবন জীবিকা চালাচ্ছেন তারা।

পাবনায় ক্রমাগত লোকসানে বিলীন হচ্ছে তাঁত

সুবর্ণা পারভীন আকিবা বলেন, শুরুতে ব্যবসা ভালোই চলছিল। আমরা প্রথম ধাক্কাটা খাই করোনায় কারখানা ও বেচাবিক্রি বন্ধ হওয়ায়। সেসময় অর্ধকোটি টাকার মতো লোকসান হয় আমাদের। এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাতেও কাজ হয়নি। উল্টো লোকসানে দেনা শুধু বাড়ছিল। পরে বাধ্য হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া হয়।

এ অবস্থা শুধু সুজানগর বা হাতেগোনা কয়েকজনের নয়, জেলার তাঁতপল্লী খ্যাত জালালপুর, চাচকিয়া, কুলনিয়া ও দোগাছিসহ তাঁতের সঙ্গে জড়িত জেলার দুই তৃতীয়াংশ মানুষের।

তাঁতবোর্ডের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী জেলায় তাঁতের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৯৭৫টি। অন্তত ১১ হাজার শ্রমিক এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জেলার সাঁথিয়া, সুজানগর ও সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তাঁত কারখানা ছিল। ২০২৪ সালে তাঁতের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজারে। মালিক হয়েছেন শ্রমিক, পেশা ছেড়েছেন অনেকেই।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৮০ কাউন্টের ২১ হাজার টাকার সুতার দাম এখন ২৮ হাজার টাকা। ১৫০০ টাকার রঙের দাম হয়েছে ৪ হাজার টাকা। তাঁতে যাওয়ার আগে সুতা প্যাঁচানোর কাজের ২০০ টাকার শ্রমিকের মজুরি এখন ৪০০ টাকা। সবমিলিয়ে ২৫০ টাকার লুঙ্গির উৎপাদন খরচ বেড়ে ৩৫০ টাকায় উঠেছে। ব্যাংক লোনের জটিলতা ও সুদও বেড়েছে। এর বিপরীতে মানুষের পোশাক ব্যবহারে পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বিক্রি। তাঁতবোর্ড বা সরকারের পক্ষ থেকে এ শিল্প বাঁচাতে নেই তেমন উদ্যোগ। এভাবেই তাঁতের সোনালি দিনের গল্প নিঃশেষ হয়েছে বলেও জানায় সংশ্লিষ্টরা।

পাবনায় ক্রমাগত লোকসানে বিলীন হচ্ছে তাঁত

তাঁতি রানা সরকার বলেন, কয়েক বছর আগেও এক গাতা (৪টি লুঙ্গি) ১৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন দাম কমে ১১০০-১২০০ টাকায় নেমেছে। সেখানে তাঁত চলবে কী করে?

সুজানগর তাঁত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রোকন বলেন, বিভিন্ন দিক থেকে ক্রমাগত লোকসানে তাঁতিরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। মালিকরা শ্রমিক হিসেবে অন্যের কারখানায় কাজ করছেন। সরকারের কাছে অনুরোধ জানাবো এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে রং-সুতার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে।

এ ব্যাপারে তাঁতবোর্ডের দোগাছি কার্যালয়ের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা ফারুখ আহমেদ ও সাঁথিয়া কার্যালয়ের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা বসুদেব চন্দ্র দাস বলেন, প্রতিবছর ধারাবহিকভাবে তাঁত কমেই চলেছে। বিভিন্ন সময় আমরা তাঁতিদের প্রণোদনা বা নানাভাবে পাশে দাঁড়াচ্ছি। তবে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে তাঁতিরা পুষিয়ে উঠতে পারছেন না। ফলে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। বিশেষ করে হস্তচালিত তাঁত একেবারেই কমে গেছে।

এ ব্যাপারে পাবনার জেলা প্রশাসক মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, হস্তচালিত তাঁতের উৎপাদন সক্ষমতা কম। ফলে এটি থেকে সরে আসছেন তাঁতিরা। তবে আধুনিক পদ্ধতির তাঁত অনেক রয়েছে। এরপরও তাদের কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলো জানালে আমরা শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সুরাহার চেষ্টা করবো। খবর জাগো নিউজ

Google News

প্রতিদিন ইসলাম অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে
Google News ক্লিক করুন।

আরও খবর

Sponsered content