জাতীয়

৫ আগস্ট শুধু বিশেষ দিবস নয় জাতির পুনর্জন্মের দিন: প্রধান উপদেষ্টা

  প্রতিনিধি ৫ আগস্ট ২০২৫ , ৮:২৪:৫৬                        

ইসলাম ডেস্ক: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ৫ আগস্ট শুধু একটি বিশেষ দিবস নয়, এটি একটি প্রতিজ্ঞা, গণজাগরণের উপাখ্যান এবং ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে জাতির পুনর্জন্মের দিন।

আরো পড়ুন:

বাংলাদেশি পর্যটক হারিয়ে হাহাকার করছেন কলকাতার ব্যবসায়ীরা

তিনি বলেন, আজ আমরা পুরো জাতি একসঙ্গে স্মরণ করছি এক এমন দিন, যা এ দেশের ইতিহাসে গভীর ছাপ রেখে গেছে।

শিক্ষার খবর সহ সকল প্রকার খবর সবার আগে জানতে
আমাদের পেইজে ফলো দিয়ে সাথেই থাকুন সারাক্ষণ

মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে দেশের সব জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক ভিডিও বার্তায় তিনি এসব কথা বলেন।

ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের আত্মত্যাগে আমরা পেয়েছি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশের জনগণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। লাখো প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

‘কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও দেশের মানুষ সুবিচার ওগণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত হয়েছে, বৈষম্যের শিকার হয়েছে। ২০২৪ সালের উত্তাল জুলাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সংকটময় অধ্যায়, ১৬ বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।’

ড. ইউনূস বলেন, দেশের বিপুল সংখ্যক তরুণ ১৬ বছর ধরে ক্রমাগত হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে। ভালো ফলাফল করেও চাকরির জন্য ক্ষমতাসীনদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে। চাকরিকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, তদবির বাণিজ্য। যে তরুণ ঘুস দিতে পারেনি, এলাকার মাফিয়াদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে পারেনি, তার চাকরি হয়নি। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি, যেটা মূলত ছিল দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আরেকটা হাতিয়ার, এর বিরুদ্ধে তরুণ সমাজ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করলেও ফ্যাসিবাদী শাসকের টনক নড়েনি।

আরো পড়ুন:

সরকারি স্কুলে ফিডিং, মাদরাসায় নয়: শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ

প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিশাল সুখবর দিলেনঃ শিক্ষা উপদেষ্টা

সরকারি চাকরি পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের তথ্য নিচ্ছে : ফারুক-ই-আজম

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দীর্ঘ এই সময় প্রতিটি সেক্টরে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করা হয়েছিল, যারা আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলবে, কাজ করবে। স্বৈরাচারের পক্ষের সঙ্গী হলেই তার চাকরি হবে, কাজ মিলবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এমনকি বিচার ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক মন্ডলেও এই ধরনের সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছিল। দেশের গরিব-মেহনতি মানুষের পয়সা লুট করে পতিত ফ্যাসিবাদ ও তাদের সহযোগীরা একেকজন টাকার পাহাড় গড়ে তোলে। সীমাহীন দুর্নীতির কবলে পড়ে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, এই দেড় যুগে প্রতিটি ন্যায্য দাবি, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের পাশাপাশি দলীয় সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের পিটিয়েছে। গত ১৬ বছরে যারাই সরকারের সমালোচনা করেছে, নাগরিকদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছে তাদের গ্রেফতার অথবা গুম করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় লাখ লাখ রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে নির্বিচারে আটক-গ্রেফতার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে চব্বিশের জুলাইয়ে দেশের ছাত্রসমাজ, তরুণ প্রজন্ম, সাধারণ মানুষ—সবাই একত্রিত হয় এক নতুন দিনের প্রত্যাশায়। সমস্বরে তারা বলে ওঠে, এবার ফ্যাসিবাদকে যেতে হবে।

‘তবু দেশের মানুষের বুকে গুলি চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল ফ্যাসিবাদী সরকার। তারা নির্বিচারে গুলি করেছে, গ্রেফতার করেছে, ইন্টারনেট বন্ধ করে হত্যাকাণ্ডের তথ্য লুকাতে চেয়েছে, রাতের অন্ধকারে এলাকায় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছাত্রদের আটক করেছে।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গুলিবিদ্ধ আহতদের তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেয়নি। হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন আহতদের ভর্তি না করা হয়। এ কারণে বহু মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে চিরতরে দৃষ্টি হারিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে।

তিনি বলেন, আজ জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে আমি জাতির সূর্য সন্তান জুলাই শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। জুলাইয়ে যারা আহত হয়েছেন, চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন, দৃষ্টি হারিয়েছেন জাতির পক্ষ থেকে আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এ জাতি আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গত বছর ডিসেম্বর মাসে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের কল্যাণ এবং যাবতীয় বিষয়াদির প্রশাসনিক দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ৮৩৬টি শহীদ পরিবারের মধ্যে ৭৭৫টি শহীদ পরিবারকে মোট ৯৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও মাসিক ভাতা বাবদ ব্যাংক চেক দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট যারা আছেন তাদেরও কয়েকটি বিষয় নিষ্পত্তি সাপেক্ষে সঞ্চয়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

পাশাপাশি আহত ১৩ হাজার ৮০০ জন জুলাই যোদ্ধাকে তিনটি ক্যাটাগরিতে নগদ টাকা ও চেক বাবদ মোট ১৫৩ কোটি ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮ জন অতি গুরুতর আহত জুলাইযোদ্ধাকে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তুরস্ক এবং রাশিয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে এবং চিকিৎসাব্যয় বাবদ এ পর্যন্ত ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

তিনি বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক বা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে সব শ্রেণির আহত জুলাইযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই শহীদ ও আহতদের জন্য আরও নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে জুলাইয়ের মহানায়কদের আত্মত্যাগ তখনই সার্থক হবে যখন এই দেশকে আমরা একটি সত্যিকারের জনকল্যাণকর দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ আমরা কেবল অতীত স্মরণ করতে আসিনি—আমরা একটি শপথ গ্রহণ করতে এসেছি। শপথ এই যে—আমরা কোনো ধরনের নিপীড়নের কাছে মাথা নোয়াবো না, আমরা প্রতিষ্ঠা করবো একটি জবাবদিহিমূলক, মানবিক, গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্র। এমন রাষ্ট্র—যা সবসময় জনকল্যাণে কাজ করবে।

তিনি বলেন, জুলাই শহীদদের আত্মত্যাগ আমরা বৃথা যেতে দেব না। তাদের আত্মত্যাগই হবে আমাদের পথচলার প্রেরণা। তাদের স্বপ্নই হবে আমাদের আগামী বাংলাদেশের নির্মাণরেখা— আজকের দিনে এটাই হোক আমাদের শপথ।

আরও খবর

Sponsered content