অপরাধ

ভুয়া ভিসার আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট

  প্রতিনিধি ২৪ আগস্ট ২০২৫ , ৬:৩৩:৫৫                        

ইসলাম ডেস্ক: রাজধানীর পুরানা পল্টনের একটি বাড়ি, আড়ম্বরপূর্ণ অফিস, নামি ব্র্যান্ডের গাড়ি আর ভিআইপির মুখোশে সাজানো একজন কূটনীতিক। প্রথম দেখায় যে কারও মনে হবে সফল ও প্রভাবশালী এক কূটনীতিক। কিন্তু এই পরিচয়ের আড়ালে সেই ব্যক্তি গড়ে তুলেছে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ভেঙে দেওয়া প্রতারণার এক ভয়ংকর চক্র। গত কয়েক বছরে হাজার হাজার মানুষ তার ফাঁদে পড়ে হয়েছেন নিঃস্ব; তাদের পাসপোর্ট, সঞ্চয় আর ভবিষ্যৎ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। দেশের পাশাপাশি ওই কূটনীতিক পরিচয়ধারী গড়ে তুলেছেন ভুয়া ভিসার আন্তর্জাতিক একটি চক্র। যেখানে নকল সিলমোহর, ইউরোপ-আমেরিকার জাল ভিসা, চার্টার্ড বিমান বুকিং টিকিট, ভিআইপিদের (অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) সঙ্গে তোলা সাজানো ছবি এবং প্রশাসনিক হোমরাচোমরাদের নাম ব্যবহার করে প্রতারণার ভিন্ন এক জাল বিছিয়েছিলেন সারা দেশে। আর এই প্রতারণার ফাঁদ এতই নিখুঁত ছিল যে, বহু মানুষ ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে তার হাতে তুলে দিয়েছেন সম্পদ, পরিবারের সঞ্চয়, এমনকি ঘরবাড়ি বিক্রির টাকা; আর বিনিময়ে পেয়েছেন ভুয়া ভিসা ও চার্টার্ড বিমানের ভুয়া বুকিং টিকিট।

আরো পড়ুন:

ভোরে দিনাজপুরে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনা,গণপরিষদের ফারুক হাসান ছিলেন যাত্রীদের সাথে

আওয়ামী নষ্ট প্রশাসন বহাল

মধ্য আমেরিকার ছোট্ট একটি দেশ বেলিজ। মূলত কৃষি, পর্যটন ও সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীল দেশটির অর্থনীতি। চার লাখ জনসংখ্যার এ দেশটির সংস্কৃতিতে মায়া, আফ্রিকান, ইউরোপীয় ও ক্যারিবীয় সভ্যতার প্রভাব লক্ষণীয়। রুগণ অর্থনৈতিক অবস্থার দরুন সেখানকার মানুষই উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছাড়েন। তবে সেই দেশের হয়ে বাংলাদেশে অনারারি কনস্যুলার হয়েছেন বাংলাদেশের অপরিচিত এক ব্যবসায়ী মশিউর রহমান। আর এই অনারারি কনস্যুলারের পরিচয়ের আড়ালে বিস্তার ঘটিয়েছেন ভয়ংকর এক প্রতারণার জাল। কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতারক চক্রটির এই মাস্টারমাইন্ডের (মূলহোতা) হাতে রয়েছে হাজার হাজার মানুষের পাসপোর্ট এবং নকল ভিসা। চক্রটির প্রতারণার নকশা এত নিখুঁত যে, কেউ প্রথমে বিন্দুমাত্রও অনুভব করতে পারেন না যে, প্রতারণার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছেন। সুসজ্জিত অফিস, দামি গাড়ি, প্রেস সেক্রেটারিসহ চাকচিক্যময় সব প্রচারণাই ব্যবহৃত হয়েছে মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এই চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে তাদের জীবন এখন দুর্বিষহ; অনেকে পাওনাদারদের চাপে বাড়িছাড়া হয়েছেন। কেউ বা আবার শেষ সঞ্চয় বিক্রি করে হয়েছেন এলাকাছাড়া। সব হারিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটছেন ওই কূটনীতিকের পেছনে।

অনুসন্ধান বলছে, ২০২১ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশে বেলিজের অনারারি কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় মো. মশিউর রহমানকে। তার দায়িত্ব ছিল দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, কনস্যুলার সেবা এবং বেলিজ ও বাংলাদেশ মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া। তবে এসবের আড়ালে ভয়ংকর এক আন্তর্জাতিক ‘ভুয়া ভিসা সিন্ডিকেট’ তৈরি করেন এই মশিউর রহমান। তার এই চক্রে প্রধান সহযোগী স্ত্রী ডেন্টিস্ট রুমানা আফরোজ। স্বামী-স্ত্রীর ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে ঘরবাড়ি ছাড়া হাজারো মানুষ। প্রতারিত এমন শত শত মানুষকে খুঁজে বের করেছে কালবেলা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভিআইপির সঙ্গে ছবি তুলে সেসব ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন। বিভিন্ন ভিআইপির সঙ্গে এডিটেড (ফটোশপের মাধ্যমে সম্পাদনা) ছবিও ছড়াতেন। এ ছাড়া বেলিজের অনারারি কনস্যুলার জেনারেল পরিচয় ব্যবহার করে ভিআইপিপাড়ায় ছিল তার অবাধ যাতায়াত। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশিদ এবং বিভিন্ন দেশের দূতসহ ভিআইপিদের সঙ্গে ছিল নিয়মিত ওঠবস। এসব ভিআইপির সঙ্গে ছবি তুলে সেসব ছবি দিয়ে বিভিন্ন নামসর্বস্ব অখ্যাত ‘গণমাধ্যমে’ প্রতিবেদন প্রকাশ করাতেন। যেমন ২০২১ সালের ২৮ জুন শাপলা টিভি নামে একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বেলিজের অনারারি কনস্যুলার মো. মশিউর রহমান।’ তবে শিরোনাম থাকলেও ভেতরে বিস্তারিত আর কিছু নেই। শিরোনামই শুধু বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা। দৈনিক নতুন সময় নামের একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বেলিজের অনারারি কনস্যুলার মশিউর রহমান।’ তবে ক্লিক করেও এই সংবাদটির ভেতরে ঢোকা যায়নি। সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সার্চ করে এমন আরও কয়েকটি প্রতিবেদন দেখা যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মশিউর রহমান ভিআইপিদের সঙ্গের এসব ছবি ও প্রতিবেদন দেখিয়ে ফাঁদ পাততেন। দেখাতেন ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত জীবনের স্বপ্ন। একবার ফাঁদে পা দিলেই সর্বনাশ। এমনই এক ফাঁদে পড়েন নূর মিয়া। তিনি জানান, মাইনুদ্দিন নামে পরিচিতি এক ব্যক্তির কাছে কাজের জন্য বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছার কথা উল্লেখ করেন। মাইনুদ্দিনের রয়েছে ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুর কোম্পানির ব্যবসা। বলার সঙ্গে সঙ্গে নূর মিয়ার কাছ থেকে ২ লাখ টাকা ও পাসপোর্ট নেন। এর এক সপ্তাহ পর পাসপোর্টে ভিসার সিল লাগিয়ে দেন। ১৫ দিনের মধ্যে ম্যানপাওয়ার করে ফেলেন (বিএমইটির ছাড়পত্র)। এরপর টিকিটও কেটে ফেলেন। এ খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজন তার বাড়িতে এসে তাদেরও ভিসার ব্যবস্থা করে দিতে অনুনয়-বিনয় করে। এমন প্রেক্ষাপটে আরও চারজনের পাসপোর্ট নেন নূর মিয়া। পাঁচজনের বাবদ টাকা দেন ৬৭ লাখ। সবার পাসপোর্টে ভিসার সিল লাগান, বিএমইটির ভুয়া ছাড়পত্রও প্রস্তুত করেন। টিকিটও কাটেন। নির্দিষ্ট তারিখে বাকি চারজন বিমানবন্দরে যান। আর নূর মিয়াকে বলা হয় অফিসে যেতে। অফিসে গিয়ে নূর মিয়া দেখেন সবার টিকিট বাতিল করা হয়েছে। নূর মিয়া কালবেলাকে বলেন, উনি প্রথমে আমাদের চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি তারিখ দেয়। ১৩ জানুয়ারি টিকিট ক্যানসেল করে দেয়। আমাকে বাসায় নিয়ে বলে, টিকিট ক্যানসেল হয়েছে। ১০ দিন পরে ফ্লাইট করিয়ে দেবে। এরপর তারিখ দেয় ২৪ জানুয়ারি। তখন বাকি চারজন বলে, ‘আমরা বাড়িতে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসছি। এখন কীভাবে বাড়ি ফিরে যাই? তখন মশিউর সবাইকে ঢাকায় হোটেলে থাকতে বলেন। তিনি এর মধ্যে ফ্লাইট করিয়ে দেবেন বলে জানান। তবে ২৪ জানুয়ারির পরে তারিখ দেন ৬ ফেব্রুয়ারি, এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি। এভাবে তারিখের পরে তারিখ দিলেও আমাদের আর ফ্লাইট করাননি। পরে জানতে পারি, সব ভিসা ছিল ভুয়া।’ এসব কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নূর মিয়া। বলেন, ‘গ্রামে আমার একটি দোকান ছিল। ওটা পাওনাদাররা নিয়ে গেছে। আমার সব শেষ। আমি এখন পাওনাদারদের ভয়ে বাড়িতে যেতে পারি না। ঢাকা শহরে পালিয়ে পালিয়ে আছি। তিনি টাকা দেবেন দেবেন বলে হঠাৎ একদিন অফিস বন্ধ করে উধাও হয়ে যান।’ নূর মিয়ার মতো প্রতারিত এমন মানুষের সংখ্যা হাজারেরও ওপরে বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। কালবেলার অনুসন্ধানে এমন শতাধিক ভুক্তভোগীর সন্ধান মিলেছে, যাদের মধ্যে একজন মো. সোহাগ হোসেন। তিনি মশিউরের ফাঁদে পড়ে আরও ৫৬ জনের পাসপোর্ট জোগাড় করে দেন। যারা সবাই এখন প্রতারিত। সব মিলিয়ে সোহাগ হোসেন ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা পাবেন মশিউরের কাছে। অন্যের টাকা দিয়ে তিনিও এখন নিঃস্ব। যেতে পারেন না বাড়িতে। অন্যদিকে অফিস বন্ধ করে দিয়ে স্ত্রীসহ পালিয়েছেন ভয়ংকর এই প্রতারক। তার খপ্পরে পড়েন দিদার ভূঁইয়া নামে আরও একজন। মশিউরের কাছে তার পাওনা ১৭ লাখ টাকা। মাইনুদ্দিন নামে আরেক ব্যক্তি পাবেন ২০ লাখ টাকা। এমন অন্তত হাজারখানেক মানুষের জীবনের গল্পটাকেই ওলটপালট করে দিয়েছেন মশিউর। এমন শতাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে কালবেলা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মশিউরের এই চক্রে রয়েছেন তার স্ত্রী ডেন্টিস্ট রুমানা আফরোজ ও বিএমইটির বহির্গমন শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা। মশিউর চক্র অফিস হিসেবে ব্যবহার করত পুরানা পল্টনের ৫০ নম্বর রুহামা কমপ্লেক্স। সেখানে রুমানা ডেন্টাল ক্লিনিক নামে মশিউরের স্ত্রীর একটি দন্ত চিকিৎসালয় ছিল। ওই আস্তানায় বসেই স্বামী-স্ত্রী মিলে ফাঁদ পাততেন। সাধারণ মানুষকে আকর্ষিত করতে ‘প্রেস সেক্রেটারি’ পদে নিয়োগও দিয়েছিলেন সুমন চৌধুরী নামে এক কথিত সাংবাদিককে। মশিউর চক্র অবিকল আসলের মতো দেখতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাল ভিসা দেখিয়ে মানুষকে প্রতারিত করত। তবে বেলিজের ভিসা তিনি নিজেই সিল-স্বাক্ষর দিয়ে ইস্যু করতেন। প্রতারণার শিকার হওয়াদের মধ্যে কুমিল্লার কামরুল হাসানের পাসপোর্ট নম্বর-ইই০৮৩৫২১৫, ঢাকার আরিফুল ইসলামের পাসপোর্ট নম্বর-এ০০৯৪২৫০৯, কুমিল্লার মাসুদ রানার পাসপোর্ট নম্বর-এ০০৮০৯১২৮, জুবায়ের হোসেনের পাসপোর্ট নম্বর-এ০২০৮৮৬৭৭, মো. নিজাম হোসেনের পাসপোর্ট নম্বর-এ০১৭৯৩৬৯৯, নোয়াখালীর নাসির উদ্দিনের পাসপোর্ট নম্বর-এ০১৯৯৫২৫৩, হাফিজুর রহমানের পাসপোর্ট নম্বর-এ০১৭৫৮১৬৫, মোহাম্মদ আলমগীর হোসেনের পাসপোর্ট নম্বর-এ০২১৩৫৭৮৬, নোয়াখালীর জাবেদের পাসপোর্ট নম্বর-এ০১৮৭৬৪৮৭, মোহাম্মদ ফাইজুল করিমের পাসপোর্ট নম্বর-এ০১৯৪৭৭৬২, কুমিল্লার মো. আরাফাত শাহজাহানের পাসপোর্ট নম্বর-এ০১৮০৮৭৮০, কুমিল্লার মোহাম্মদ নাইমুর রহমানের পাসপোর্ট নম্বর- এ০০৬৮১১৭৮, নোয়াখালীর মো. ফয়সাল উদ্দিনের পাসপোর্ট নম্বর-এ০০১৮২৪৬৪, নারায়ণগঞ্জের আরমান হোসেনের পাসপোর্ট নম্বর-বিডব্লিউ০১৮১৭৬৩, কুমিল্লার মোহাম্মদ মারুফ উজ জামানের পাসপোর্ট নম্বর-এ০২১৭২৬৩০, মো. রাশেদ হোসেনের পাসপোর্ট নম্বর- এ০০৫৪৮২৬৬, ফয়সাল আহমেদের পাসপোর্ট নম্বর-ইএফ০৩৩৮৪৯৯, আরমান হোসেনের পাসপোর্ট নম্বর-বিডব্লিউ০১৮১৭৬৩ এবং চাঁদপুরের অন্তর শাহার পাসপোর্ট নম্বর-ইএ০০৭৪০৩১। জাল ভিসার এই চক্রে সম্পৃক্ত বিএমইটি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে করাতেন ম্যানপাওয়ার বা মাইগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স। এরকম জাল ভিসায় করা কয়েকটি ক্লিয়ারেন্সের রেজিস্ট্রেশন নম্বর-ইমরান হোসেনের এ০৪৫৯১৩৭৩ পাসপোর্টের বিপরীতে ডি০০০৯০৩২১ ভিসায় ক্লিয়ারেন্স পেয়েছেন। যার নম্বর-বিজেড-আই-২০২৪-৪০০০৬৩। আমাদুল হক বিজয় নামে একজন পাসপোর্ট নম্বর এ১৩৭২০৯৯-এর বিপরীতে ক্লিয়ারেন্স নিয়েছেন। যার নম্বর-বিজেড-আই-২০২৪-৪০০০৬৪। উমায়ের হোসেন নামে একজনের পাসপোর্ট নম্বর-এ১৫৫৭৫১৭৩-এর বিপরীতে ক্লিয়ারেন্স নম্বর-বিজেড-আই-২০২৪-৪০০০০৬১, মাইন উদ্দিন রাজু নামে একজনের এ০৮৮৮৬১৯৯ পাসপোর্টের বিপরীতে ক্লিয়ারেন্স নম্বর- বিজেড-আই-২০২৪-৪০০০০৫৮।

বেলিজের যেসব ভুয়া ভিসা দিয়েছে, মশিউর তার মধ্যে অনেক ভিসার বিপরীতেই বিএমইটির বৈধ ছাড়পত্র রয়েছে। কালবেলার পক্ষ থেকে ভিসাগুলো বিএমইটি থেকে নিরীক্ষা করা হলেও ছাড়পত্র দেওয়ার প্রমাণ মেলে। এমন কয়েকটি ছাড়পত্রের কপি কালবেলার হাতেও রয়েছে। বিএমইটির ক্লিয়ারেন্সের অর্থ হলো—নিরাপদ অভিবাসনের নিশ্চয়তা। বিএমইটি ভিসা ও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তিপত্র যাচাই-বাছাই করে ছাড়পত্র ইস্যু করে। তবে ভিসাই যেখানে জাল, সেখানে মাইগ্রেশনই সম্ভব নয়। জাল ভিসায় এমন ছাড়পত্র দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টর। জানতে চাইলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উপপরিচালক (বহির্গমন) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, ‘এটা তো হতে পারে না। এটা তো হওয়া উচিত নয়। ঠিক কীভাবে হলো—বুঝতে পারছি না। আর তখন আমি এখানে ছিলামও না।’

প্রতারিত ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মশিউর সাধারণত ইউরোপের উন্নত জীবনে স্বপ্ন দেখাতেন। এরপর কেউ টাকা জমা দিলে সপ্তাহখানেকের মধ্যে তাকে অবিকল আসলের মতো দেখতে একটি জাল ভিসা বানিয়ে পাসপোর্টে লাগিয়ে দিতেন। মশিউর সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভুয়া ভিসায় ম্যানপাওয়ার করিয়ে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিতেন। এরপর বুকিং দিতেন বিমানের টিকিট। এসব কিছু ঘটে যেত এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে। বিষয়টি জানাজানি হলে গ্রামের অর্ধশিক্ষিত, নিরক্ষর মানুষ কোনো কিছু না বুঝেই ইউরোপের জীবনের স্বপ্নে সহায়-সম্বল বিক্রি করে টাকা এনে দিতেন মশিউরের হাতে। আর একবার টাকা দিলেই ফেঁসে যেতেন জালে। এরপর ফ্লাইটের আগের দিন টিকিট ক্যানসেল করে নতুন তারিখ দিতেন। নিজের অফিসিয়াল প্যাডেও এমন নির্দেশনা দিয়েছেন। এমন কিছু নথি কালবেলার হাতে এসেছে। যার একটি প্যাডে লেখা—‘প্রিয় সোহাগ সাহেব, আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আপনার মাধ্যমে রিপাবলিক অব বেলিজ এ ওয়ার্ক পারমিটে যেসব যাত্রী এরই মধ্যে বেলিজ ভিসার সব কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে, বেলিজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মোতাবেক তাদের ফ্লাইট পরিবর্তন হয়ে আগামী ০৩-০৬-২০২৩ ইং নির্ধারিত হয়েছে। যেহেতু রিপাবলিক অব বেলিজ থেকে মাননীয় সেক্রেটারি তাদের একই ফ্লাইটে বেলিজ নিয়ে যাবেন, যাতে কারও কোনো সমস্যা না হয়। উক্ত ০৩-০৬-২০২৩ ইং তারিখে তাদের যাত্রা নিশ্চিত করা হয়েছে, কোনো অবস্থাতেই এ তারিখ পরিবর্তন করা হবে না।’ তবে এসব কথিত তারিখ পরিবর্তন, সরকারি প্যাড ও সিলমোহর ব্যবহার শুধু প্রতারণার অংশ।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে মশিউর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও কোনো সাড়া মেলেনি। পরে প্রশ্ন লিখে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর দেননি। এরপর গত ১৮ আগস্ট মশিউর রহমানের নয়াপল্টনের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালাবদ্ধ। জানতে চাইলে অন্য ভাড়াটিয়ারা কালবেলাকে জানান, মাস দুয়েক আগে অফিস ছেড়ে পালিয়ে গেছে মশিউর। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ নেই। কোথায় গেছেন, সেটিও কেউ বলতে পারেননি।

এমন প্রতারণার বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হলেও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তারা বলেন, বিষয়টি তাদের গোচরে ছিল না। এমন ঘটনা অস্বাভাবিক। ঘটনা সত্য হলে অবশ্যই বিষয়টি আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে বেলিজের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত ১০ দিনে দুই দফা ই-মেইল করা হয়। তবে তারা কোনো জবাব দেয়নি। একইভাবে বেলিজে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুলার অফিসে ই-মেইল করলেও কোনো জবাব দেয়নি।

জানতে চাইলে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, ‘এটা তো ভয়াবহ প্রতারণা। কনস্যুলার নিজেই যদি প্রতারণা করে তাহলে মানুষ কার কাছে যাবে। তাকে কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। এ ছাড়া যারা প্রতারিত হয়েছে তাদের টাকা ফেরত দেওয়াসহ জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে রাষ্ট্রকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই।’

আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘এটি একটি বহুমাত্রিক প্রতারণা। তাকেসহ (মশিউর) তার নিয়োগের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থার যারা জড়িত, তাদের সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কারণ গোয়েন্দা সংস্থার ক্লিয়ারেন্স ছাড়া এ ধরনের নিয়োগ হয় না। এ ছাড়া তার প্রতারণায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের সবাইকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সঠিক তদন্ত করলে মানব পাচার এবং অর্থ পাচারের মতো বিষয়গুলোও বেরিয়ে আসতে পারে।’

Google News

প্রতিদিন ইসলাম অনলাইনের খবর পেতে
Google News ক্লিক করুন।

আরও খবর

Sponsered content