বিদেশি কর্মী নিপীড়নের অভিযোগ মালয়েশিয়ার অর্থনীতির জন্য হুমকি - protidinislam.com | protidinislam.com |  
অর্থনীতি

বিদেশি কর্মী নিপীড়নের অভিযোগ মালয়েশিয়ার অর্থনীতির জন্য হুমকি

  প্রতিনিধি ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ , ১২:২৪:৫০ প্রিন্ট সংস্করণ

Spread the love

ইসলাম ডেস্কঃ মালয়েশিয়ার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি বিদেশি কর্মী। দেশটির মোট শ্রমশক্তির ১০ শতাংশই হচ্ছে এসব বিদেশি। ২০২০ সালের শেষের দিকে মালয়েশিয়ায় বৈধ বিদেশি কর্মী ছিল প্রায় ২০ লাখ, অনিবন্ধিতদের সংখ্যা এর দ্বিগুণ বলে ধারণা করা হয়।

মালয়েশীয় পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যমতে, গত দুই দশকে দেশটিতে বিদেশি কর্মী বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। তবে, একই সময়ে বেড়েছে জোরপূর্বক শ্রমের মতো গুরুতর অভিযোগও।

এসব অভিযোগ মালয়েশিয়ার রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত কয়েক দশকে বিদেশি কর্মীদের ওপর নির্ভর করে কৃষি ও উৎপাদন খাত অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে মালয়েশিয়া। ধীরে ধীরে সেমিকন্ডাক্টর, আইফোন যন্ত্রাংশ, মেডিক্যাল গ্লাভস, পাম তেলের মতো বৈচিত্র্যময় পণ্যসম্ভারে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে তারা।

একই সময়ে বিদেশি কর্মীদের ওপর মালয়েশিয়ার নির্ভরতাও বেড়েছে। দেশটিতে ইন্দোনেশিয়া,বাংলাদেশ ও নেপালের বিপুল সংখ্যক কর্মী কাজ করছেন

তবে মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মী-নির্ভরতা বাড়ার পাশাপাশি তাদের কাজ ও বসবাসের জায়গা সংক্রান্ত অভিযোগের পাহাড় তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার অর্থনীতি সম্পর্কে ১১ বিশ্লেষক, রেটিং সংস্থা, গবেষক, করপোরেট পরার্মশক ও সমাজকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

তারা বলেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিকে এগিয়ে যেতে হলে অবশ্যই শ্রম আইন সংশোধন ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কর্মীদের অবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

রয়টার্সের খবর অনুসারে, জোরপূর্বক শ্রমের অভিযোগে গত দুই বছরে মালয়েশিয়ার সাতটি প্রতিষ্ঠান মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে। এদের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম গ্লাভস নির্মাতা ও পাম তেল উৎপাদকও রয়েছে।

গত মাসে অত্যাধুনিক গৃহস্থালী পণ্য নির্মাতা ডায়সন লিমিটেড তাদের বৃহত্তম সরবরাহকারী একটি মালয়েশীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কেচ্ছেদ করেছে। অভিযোগ, একই।

কুয়ালালামপুরের অ্যামব্যাংক রিসার্চের প্রধান অ্যান্থনি ডাসের মতে, এটি একটি সতর্ক সংকেত। মালয়েশিয়া পরিবর্তন না আনলে তাদের ব্যবসা অন্যত্র চলে যেতে পারে।

মালয়েশিয়ার শ্রম আইন পরিবর্তনের বিষয়ে মন্তব্যের জন্য দেশটির শ্রম বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স। তবে তাতে সাড়া মেলেনি। ব্যবসা চলে যাওয়ার ঝুঁকির বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হয়েছিল দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। তারাও কিছু বলতে চায়নি।

তবে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম. সারাভানান চলতি মাসের শুরুর দিকে স্বীকার করেছেন, জোরপূর্বক শ্রম ইস্যুটি মালয়েশিয়ার পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় প্রভাব ফেলেছে। এসময় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি কর্মীদের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

লন্ডনভিত্তিক নৈতিক বাণিজ্য পরামর্শক ইমপ্যাক্টের রোজি হার্স্ট বলেছেন, জোরপূর্বক শ্রম সমস্যার ‘পোস্টার চাইল্ড’ হয়ে উঠেছে মালয়েশিয়া এবং এটি তাদের অর্থনীতির ক্ষতি করতে শুরু করেছে। তার কথায়, মালয়েশিয়ার শ্রম ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন বেড়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সত্যিকারের পরিবর্তন দরকার।

চীন, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার অন্য ম্যানুফ্যাকচারিং হাব বা উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতেও কর্মী নিপীড়ন নিয়ে একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে মালয়েশিয়ায় সাম্প্রতিক বিতর্ক নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা এবং এটি ভবিষ্যতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও সরবরাহ চুক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

জোরপূবর্ক শ্রমের নমুনা
মালয়েশীয় কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, দেশটিতে অতিরিক্ত ওভারটাইম, অপরিশোধিত মজুরি, বিশ্রামের দিনের অভাব এবং অস্বাস্থ্যকর ডরমেটরি সমস্যা রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নজরে জোরপূর্বক শ্রমের ১১টি সূচকের মধ্যে এসব সমস্যাও রয়েছে।

মালয়েশিয়ার বর্তমান আইনে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৬০ ঘণ্টার বেশি কাজ করানোর অনুমতি রয়েছে এবং বিশ্রামের দিনগুলোতেও কর্মীদের দিয়ে কাজ করানো যায়।

রোজি হার্স্ট বলেন, মালয়েশিয়ার আইনি কাঠামো অনুমতি দেয়, এমনকি কখনো কখনো এমন কর্মকাণ্ডে জোর দেয়, যেগুলো আইএলও’র জোরপূর্বক শ্রমের ১১টি সূচকের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অবশ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি গত মাসে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা শুরু করেছে, যার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে জোরপূর্বক শ্রমের অভ্যাসগুলো নির্মূলের কথা বলা হচ্ছে।

মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মীরা সাধারণত উৎপাদন, কৃষি, নির্মাণ ও সেবা খাতে কাজ করেন। মালয়েশীয় নাগরিকরা নিম্নবেতন, কঠিন কাজের জায়গাগুলোতে আগ্রহী কম হওয়ায় দেশটির ইলেক্ট্রেনিকস ও পাম তেল কোম্পানিগুলো প্রধানত বিদেশি কর্মীদের ওপরই নির্ভর করে থাকে। এসব জায়গায় বিদেশি কর্মীদের সঙ্গে হওয়া আচরণ নিয়েই বিতর্ক চলছে।

চীনের পর মালয়েশিয়াই সবচেয়ে বেশি মার্কিন শুল্ক নিষেধাজ্ঞার শিকার। গত জুলাই মাসে শ্রম পাচার নির্মূলে সীমিত অগ্রগতির জন্য চীন ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একই তালিকায় মালয়েশিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল ওয়াশিংটন, যা তাদের সর্বনিম্ন র্যাংকিং।

মালয়েশিয়ার যন্ত্রাংশ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এটিএ আইএমএস রেকর্ড মুনাফা লাভের হিসাব প্রকাশের কয়েক মাসের মাথায় তাদের সঙ্গে সম্প্রতি চুক্তি বাতিল করেছে ব্রিটিশ কোম্পানি ডায়সন। এটিএ এরপর কিছু নিয়ম লঙ্ঘনের কথা স্বীকার করে এবং জানায়, তারা এখন সব নিয়ম ও মানদণ্ড অনুসরণ করছে।

‘আধুনিক দাসত্ব’
যুক্তরাষ্ট্র গত বছর মালয়েশিয়ার টপ গ্লাভ করপোরেশনকে নিষিদ্ধ করার পর বিশ্বের বৃহত্তম মেডিক্যাল গ্লাভস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি তার কর্মীদের স্বদেশে প্রদত্ত নিয়োগ ফি পরিশোধের জন্য ৩ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার দিতে রাজি হয়। এটি ‘ঋণ দাসত্ব’ তৈরি করছে বলে অভিযোগ সমাজকর্মীদের। তবে পরিবর্তন আনার পর টপ গ্লাভের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে মার্কিন রাজস্ব দপ্তর।

টপ গ্লাভ এক বিবৃতিতে রয়টার্সকে বলেছে, গত কয়েক বছরে ক্রেতাদের প্রত্যাশা বদলে যাওয়ায় রপ্তানিকারকদের অবশ্যই ‘সর্বোত্তম বৈশ্বিক রীতিনীতি’ অনুসরণ করতে হবে। ব্যবসার জন্য শুধু সাশ্রয়ী হওয়া এখন আর যথেষ্ট নয়।

বিশ্বের বৃহত্তম পাম তেল রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়ার পরেই অবস্থান মালয়েশিয়ার। নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ার পর দেশটির পাম উৎপাদনকারীরা কর্মীদের জীবনমান উন্নয়নে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করেছে। তবে কর্মস্থল ও কর্মীদের জীবনমানের উন্নয়নে বাড়তি খরচ বিনিয়োগকারীদের দূরে সরিয়ে দেবে, এমন আশঙ্কা নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফিচ রেটিং’র সাসটেইনেবল ফাইন্যান্সের পরিচালক নেকা চিকে-ওবি জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজ্যে ব্যবসারত প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ ব্যবস্থায় আধুনিক দাসত্ব প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইনের অধীন। সুতরাং, সরবরাহ ব্যবস্থায় তুলনামূলক কম ঝুঁকির বিনিময়ে কিছুটা বাড়তি খরচ তারা মেনে নিতে পারে।

মালয়েশিয়ার ইলেক্ট্রনিকস শিল্পের জন্য এসব অভিযোগের প্রভাব আরও তীব্রতর হতে পারে। দেশটির মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশই আসে এই শিল্প থেকে। মালয়েশিয়ায় উৎপাদন কারখানা রয়েছে ডেল, স্যামসাং, ওয়েস্টার্ন ডিজিটাল করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর। আবার স্থানীয় সরবরাহকারীদের ব্যবহার করে অ্যাপল।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে উদ্বেগ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি স্যামসাং। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও রয়টার্সের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। তবে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো যদি মালয়েশীয়দের সঙ্গে চুক্তি প্রত্যাহার শুরু করে, তবে সেটি দেশটির অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অ্যামব্যাংকের অ্যান্থনি ডাস।

সূত্র: রয়টার্স

আরও খবর

Sponsered content

ENGLISH